ওয়েব ডেস্ক: ঢাকার মডেল থানার মধ্যে অন্যতম মিরপুর থানা। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে কয়েকটি থানা বেশি আক্রান্ত হয় তার মধ্যে অন্যতম মিরপুর মডেল থানা। তিনতলা বিশিষ্ট থানার পুরোটাই আগুনে পুড়েছে। আহত হয়েছেন অনেকে। পুলিশ সদস্যদের বাঁচাতে সেখানে সেদিন অবস্থান নিতে হয়েছিল সেনা সদস্যদের।
রোববার (১১ আগস্ট) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, পুড়ে গেছে পুরো থানা কমপ্লেক্স। এখনও যায়নি পোড়া গন্ধ। থানা চত্বরে থাকা রায়ট কার, পুলিশের পিকআপ ভ্যান আর মোটরসাইকেল এখনও সেদিনের ভয়াবহতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। থানার ভেতরে ঢোকার মূল গেটে পড়ে আছে পুলিশ সদস্যদের পোশাক। ধ্বংসস্তূপের মতো পড়ে আছে থানার সব কাগজপত্র, নথি। পুড়ে ভস্মীভূত চেয়ার-টেবিলসহ সব আসবাবপত্র। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এটি ঢাকার একটি মডেল থানা।
শুধু এই থানাই নয়, ডিএমপির ৫১ থানার মধ্যে ৩টি বাদে সব থানাই কমবেশি আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২০টি থানার অবস্থা খুবই নাজুক। কঙ্কালসারে রূপ নিয়েছে যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, ভাটারা, উত্তরা পশ্চিম ও আদাবর থানা। হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ থানাই এখনও রয়ে গেছে ব্যবহারের অনুপযোগী অবস্থায়। যদিও ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে সীমিত পরিসরে অধিকাংশ থানায় বিকল্প ব্যবস্থায় শুরু হয়েছে কার্যক্রম।
শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে শুরু থেকেই মারমুখী ছিল পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক নিপীড়ন আর ধরপাকড়ে ছাত্রদের সেই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটার আন্দোলন গিয়ে ঠেকে এক দফার সরকার পতনের আন্দোলনে। সেই আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগে ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে পড়ে বাংলাদেশ পুলিশ। থানা, ট্রাফিক স্থাপনায় হামলা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ সদস্যদের মারধর ও হত্যার ঘটনা ঘটে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সারা দেশে পুলিশি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ সদস্যরা থানায় আসতে সাহস পাননি। স্থাপনা পাহারা দেওয়ার জন্য আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়।
পুলিশের নতুন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম গত ৭ আগস্ট পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। পরদিন তিনি পুলিশ সদস্যদের কর্মস্থলে যোগদানের ক্ষেত্রে আপামর জনসাধারণকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। তাতে কিছুটা কাজ হলেও এখনও কর্মে ফেরেননি অনেকে।
এদিকে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে সব পুলিশ সদস্যকে কর্মস্থলে যোগ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি আজ রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশের যেসব সদস্য এখনও কাজে যোগ দেননি, তাদের জন্য শেষ সময় হচ্ছে আগামী বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবারের মধ্যে যদি কেউ যোগ না দেন, তাহলে ধরে নেওয়া হবে তারা চাকরিতে ইচ্ছুক নন।
তিনি বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর লুট হওয়ার খবর পাচ্ছি। আমাদের সেনাবাহিনী ও বিজিবি মাঠে আছে কিন্তু এটা তাদের কাজ না। পুলিশের যেটা কাজ, সেটা তারা পারে না। পুলিশ ছাড়া আমাদের সমাজ চলতে পারে না।
রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর সদস্যরা থানার মূল ফটকের সামনে সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন। ভেতরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িত ছাত্ররা কাজ করছেন। সেখানে কথা হয় থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মনির মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, থানার অবস্থা কি সেটা তো দেখছেনই। ভেতরে কাজ করার মতো পরিবেশ নেই। ওসিসহ সিনিয়র স্যার ফিরেছেন। অনেকে আতঙ্ক নিয়ে অনেকে ফিরলেও যোগ দেননি। যারা ফিরেছেন তারা সিভিলে চলাফেরা করছেন।
মনির মিয়া বলেন, থানায় জিডি নেওয়া হচ্ছে। অনলাইন জিডি করতেও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো মামলা নথিভুক্ত করার মতো অবস্থা নেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বৃহত্তর মিরপুরের সমন্বয়কদের একজন সায়েম। তিনি বলেন, থানা ধোয়া-মোছার কাজ করা হচ্ছে। লুট হওয়া অস্ত্রসহ যানবাহন উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুটি যানবাহন ও ৩৫টি অস্ত্র উদ্ধার করে আমরা সেনাবাহিনীকে দিয়েছি।
অন্যদিকে, মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে দেখা যায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সহিংসতায় পুড়েছে থানাটির বেশিরভাগ কক্ষ, থানা চত্বরে থাকা গাড়ি, মামলার কাগজপত্র, নথি। পুরো ভবন যেন কঙ্কালসার।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, থানার কোনো কিছুই ঠিক নেই। চেয়ার-টেবিলও নেই যে বসে কাজ করব। ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিকঠাক হবে। বলতে পারেন ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে কাজের চেষ্টা করছি।
রাজধানীর আদাবর থানার গিয়ে নিরাপত্তায় দেখা যায় সেনাবাহিনীকে। সেবা নিতে আসা কেউ থানায় ঢুকতে গেলে পরিচয় ও কারণ জানাতে হচ্ছে। এসময় ৭-৮ জন শিক্ষার্থীকে থানায় প্রবেশ করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে দেখা যায়।
রাজধানীর অক্ষত থানাগুলোর একটি তেজগাঁও থানা। দুপুরে থানায় গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটক তালাবদ্ধ। নেই কোনো আনসার কিংবা পুলিশ সদস্য। ডাকলে ভেতর থেকে আনসার সদস্যরা সাড়া দিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলছে থানার কার্যক্রম।
মোবাইল ফোনে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, পুলিশ জনগণের প্রয়োজনেই কাজ করে। আজ আমরা ট্রমাটাইজড। আমাদের ব্যর্থতা আমরা অনেক সময় জনগণকে বোঝাতে পারি না। এমন অবস্থার মধ্যেও জনগণের প্রয়োজনে আমাদের ফিরতে হচ্ছে। ফিরতে হবে। আমরা নির্দেশনা পাওয়ার পর থানায় চলে এসেছি। এখনও আমার অনেক সহকর্মী কান্না করছে, আসতে পারছে না। থানার কার্যক্রম পুরোপুরি চালু করা হয়েছে। তবে মামলা করতে কেউ আসছে না। জিডি হচ্ছে টুকটাক।
তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক মোবাইলে বলেন, অনেক সদস্য এখনও আতঙ্কে। অনেকে কর্মবিরতিতে নানা সংস্কার আর দাবি-দাওয়া নিয়ে। আমরা চেষ্টা করছি সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে। তেজগাঁও বিভাগের সবগুলো থানা (তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরেবাংলা নগর ও হাতিরঝিল) চালু হয়েছে। তবে সব থানায় এখনই জিডি-মামলা করা যাচ্ছে না।
মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, সব থানাতেই আমাদের লোকজন আছে। সব থানাতেই জিডি হচ্ছে। আমার অফিস ঠিক থাকলেও পল্টন, খিলগাঁও, মুগদা থানা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিতির পর বললেই সব ঠিক হয়ে যায় না। চেষ্টা চলছে। আতঙ্ক কাজ করছে। যারা ফিরেছে তাদের বলেছি আপাতত সিভিলে কাজ করতে।
সারা দেশে ৫৯৯ থানার কার্যক্রম চালু
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা সব থানার কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে বলে দাবি করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এরই মধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এখন পর্যন্ত ৫৯৯টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে সারা দেশে। রোববার (১১ আগস্ট) এক বার্তায় এ তথ্য জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, সারা দেশে ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৯৯টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ১১০টি মেট্রোপলিটন থানার মধ্যে ৯৭টি এবং জেলার ৫২৯টি থানার মধ্যে ৫০২টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর উত্তেজিত জনতা রাজধানীসহ সারা দেশে পুলিশের বিভিন্ন থানাসহ সাড়ে ৪শর বেশি স্থাপনায় হামলা, আগুন ও লুটপাট হয়েছে। হামলা ও আগুন থেকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সও রেহাই পায়নি। একের পর এক হামলায় পুলিশের অনেক কর্মকর্তা ও সদস্য নিহত ও আহত হয়েছেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার ৪২ পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম। এ ছাড়া বহু সদস্য আহত রয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫০৭ জন।
রোববার (১১ আগস্ট) দুপুরে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার খোঁজখবর নিতে যান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন আইজিপি।
সেখানে আইজিপি ময়নুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আন্দোলন দমন করতে গিয়ে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার ৪২ পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন র্যাব সদস্য রয়েছেন। এ ছাড়া বহু আহত রয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালেই ৫০৭ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ছাড়া হামলায় গুরুতর আহত ২৭ জন পুলিশ সদস্য ভর্তি রয়েছেন, যার মধ্যে একজন আইসিইউতে আছেন। আহতদের চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি। পাশাপাশি আহতদের পরিবারকে মানসিকভাবে সাপোর্ট ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছি।